Skip to main content


Dr. Tofayel Ahmed Life Sketch

অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ এর জীবনী সংক্ষেপ

                                                 অধ্যাপক (ডা.) মোঃ সিরাজুল ইসলাম

                                                                      এমবিবিএস, এফসিপিএস,(পেডি) পিএইচডি

প্রয়াত অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ 01 জানুয়ারী 1929 সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কাজীরপাগলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, কোলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক শিক্ষা লাভ করেন। ছাত্র জীবনে ডা. তোফায়েল আহমেদ 19511952 সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। যার দরুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য প্রশাসন বিভাগ থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রাষ্টিকেট করার জন্য সুপারিশ করেন। ডা. তোফায়েল আহমেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে প্রথম প্রকাশিত ম্যাগাজিনের সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 1953 সালে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। এছাড়া 1956 থেকে 1959 সাল পর্যন্ত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ডে স্নাতকোত্তর যোগ্যতার জন্য অধ্যায়ন করেন। ডা. তোফায়েল আহমেদ 1967 সাল থেকে 1971 সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের করাচিতে ‘জিন্নাহ স্নাতকোত্তর মেডিকেল সেন্টারে শিশু স্বাস্থ্যের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন’। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, ঔষধ বিতরণের জন্য স্বাস্থ্য সেবা ক্লিনিকের আয়োজন করেছিলেন। এই মানবিক কার্যক্রমের প্রশংসা করে 1973 সালের মে মাসে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।

ডা. তোফায়েল আহমেদ 1974 সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী ব্যুওনস আয়্যারসে (Buenos Aires) অনুষ্ঠিত চতুর্দশ আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অব পেডিয়েট্রিক্স সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়া একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত শিশু বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে মনোনীত করার বিষয়ে তিনিই প্রথম প্রমাণপত্র উপস্থাপন করেন। 1975 সালে ডা. তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ পেডিয়েট্রিক্স (বাংলাদেশ জার্নাল অব চাইল্ড হেলথ) এর প্রথম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।

1975 সালে ডা. তোফায়েল আহমেদ যুক্ত রাষ্ট্র কর্তৃক এফ.সি.সি.পি সনদ প্রাপ্ত হয়ে বিশেষ সম্মান অর্জন করেন এবং 1975 সালে শিশু রোগের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তিনিই প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অব পেডিয়েট্রিক্স এর ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। 1977 সালে ডা. তোফায়েল আহমেদকে লন্ডনের ট্রপিক্যাল মেডিসিনের রয়্যাল ফেলোশিপ দেয়া হয় ও জাকার্তায় দ্বিতীয় এশিয়ান পেডিয়েট্রিক্স কংগ্রেসের বৈজ্ঞানিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। 1981 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডা. আহমেদকে শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ হিসেবে এফ.এ.এ.পি ডিগ্রী প্রদান করেন।

অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ ঢাকা শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম ঢাকার শের-ই-বাংলা নগরে ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বন্দোবস্তসহ বর্তমান বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল এন্ড ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর অধ্যাপক আহমেদ সেখানে পল্লী (Rural) ও কমিউনিটি পেডিয়েট্রিক্স (Community Paediatrics) বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুর্ধ্ব পাঁচ (5) বছর বয়সী শিশুদের স্বাস্থ্য সেবায় গঠিত ক্লিনিকসমূহের জাতীয়ভাবে সমন্বয়কারী হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি শিশু বিষয়ক জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং সারা দেশে বিভিন্ন গ্রামীণ শিশু স্বাস্থ্য প্রকল্পের অোয়োজন করেন। অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ এশিয়ান পেডিয়েট্রিক্স সোস্যাইটির উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য এবং ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অব পেডিয়েট্রিক্সের সিনেটর ছিলেন। অধ্যাপক আহমেদ বাংলাদেশে গ্রাম্য দরিদ্র জনসাধারণের স্বাস্থ্য সেবায় পল্লী শিশু ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শুধু তাই নয় অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ আন্তর্জাতিক পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট শিশু (IPGMR) বিভাগের গেস্ট লেকচারার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের পেডিয়েট্রিক বিভাগের অনারারি কনসালটেন্ট ছিলেন। এছাড়াও তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সফলতার সাথে “ফাইজার বাংলাদেশ লিঃ (বর্তমান রেনেটা লিঃ)”-এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যাপক ডা. আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন এন্ড ফুড সায়েন্সের বোর্ড অব গভর্নরস (Board of Governors)-এর সদস্য এবং NIPSOM এর একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত হন। তিনি সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ টীকাদান কার্যক্রমের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। অধ্যাপক ডা. আহমেদ 1983 সালে ঢাকা শিশু হাসাপাতালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ নামক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর একাডেমিক কাউন্সিলের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালে অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ এর 28 টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তিনি গ্রামীণ শিশুদের নিয়ে লেখা দুটি বইয়ের রচয়িতা। 1979 সালে বাংলায় ‘পল্লী শিশু’ এবং 1982 সালে ইংরেজিতে চিকিৎসা সেবায় পেশাজীবিদের জন্য ‘উন্নয়নশীল দেশগুলিতে গ্রামীণ শিশু রোগ’ শিরোনামে বাংলাদেশের প্রথম পেডিয়েট্রিক বই প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সরকারের মহামন্য রাষ্ট্রপতি তাঁকে জুন 1984 সালে অনুষ্ঠিত মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন। এছাড়াও অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ 1987 সালে ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অব পেডিয়েট্রিক্স এ্যাসোসিয়েশন এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। শিশু রোগ বিষয়ের উপর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি “অতীশ দীপঙ্কর” স্বর্ণপদকও লাভ করেন।

অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ ছিলেন মূলত বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ। মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে তার অবদান ও কৃতিত্ব চির অনবদ্য আর স্মরণীয়। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী তথা প্রখ্যাত শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ 12-ই মার্চ 1997 খ্রিঃ তারিখে বার্ধক্যজনিত কারণে পরলোক গমন/শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ তাঁর সুদীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে বিশেষ করে গ্রামীণ মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে দেশে বিদেশে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের অংশ হিসেবেই ঢাকার আগারগাঁওয়ে আজকের ঢাকা শিশু হাসপাতাল (বর্তমান নাম বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল এন্ড ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যার অবদানের কথা শুধু বর্ণনায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় বরং তা বাংলাদেশের ইতিহাস ও প্রতিটি মানুষের গ্রথিত হৃদয়ে স্বর্ণালী শোভায় চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।

Subscribe